মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর

মেয়েটিকে নিয়ে এখন কী করা যায়?
মধ্যরাত শেষের অস্থিরতায় এই প্রশ্ন বড় জোরালো হয়ে ওঠে। গোর-এ-শহিদ ময়দানের বিস্তৃত ফুটবল গ্রাউন্ড। পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে চিকন রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ চলে গেছে। ডিসি সাহেবের বাসভবন। সার্কিট হাউস। আরও সামনে…সে যা হোক, ফুটবল মাঠের পশ্চিমে রাস্তা, তার পুবে জল নিষ্কাশনের সরু খাল ছেড়ে কাঠের কয়েকটি ঘর নিয়ে গ্রিনরুম কাম রেস্টহাউস। মেকআপ আর বিশ্রামাগার। মার্চ শেষে এপ্রিলের পাতাঝরা তপ্ত দিনকাল। কখনো বাতাসে গুমোট তাল-লয়ে বারুদের হালকা স্পর্শ লেগে থাকে। সেই গন্ধে জড়িয়ে থাকে শুকনো রক্তের বীভৎস দাগ। রাস্তার গোপন কোঠরে এবং প্রকাশ্যে ছড়িয়ে থাকা লাশের ব্যাদান চোখ-মুখ। কখনো শকুন আর কুকুরে খুবলে তুলছে মৃত মানুষের শরীর। শহরের রাস্তায় মহল্লার অলিগলিতে মানুষ মানুষের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। চোখে-মুখে ভয়-ভক্তি-আশঙ্কা লেপটে থাকে। ভক্তির উৎস অন্য কোথাও, সেটি অন্ধ মোহ কিংবা স্বার্থবুদ্ধির কূটজাল কে জানে। মানুষ আপাতত বিচ্ছিন্ন আবার সংঘবদ্ধ হয়ে সকল দূরত্ব হ্রাসে কাজ করে যায়। কেউ কেউ নিজেদের ঘরদোর পাহারা দিয়ে রাখে। রাত পাহারা চোখ অন্ধকারের প্রহর গুনে গুনে সতর্ক সাবধান। এর মধ্যে মেয়েটি।
আমরা জেগে থাকি। টিমের নয়জন তিনভাগে দুই-তিন প্রহরের দেখাশোনা। কোথায় কী হয়? কী হতে পারে? কী হচ্ছে বা হতে চলেছে? এইসব অস্থির ভাবনার মধ্যে দায়িত্বের অংশ হিসেবে অন্ধকারের রাস্তা-অলিগলি আর পাড়াগুলোর আশপাশ মহল্লার চারিদিকে তাকাতে হয়। পশ্চিমে রাস্তা পেরিয়ে মিশনরোড। কাঁচাপাকা খড় ছাউনির ঘর, টিন ছাপরা আর দু-চারটি সাদা বিল্ডিং। পনেরো-কুড়ি পরিবারের সত্তর-আশিজন মানুষ। কয়েকদিন আগেও এই ঘরগুলোয় বুড়োবুড়ি আর জেদি মানুষজন ছাড়া কেউ ছিল না। ওদিকে কয়েকটি বিশাল দেবদারু আমগাছের উন্মুক্ত ছায়ায় ছোট ছোট টোপর-ঘর, ঘরের সারি, বিস্রস্ত আসবাব-তৈজস, এখানে-ওখানে বেঁধে রাখা বা মুক্ত ছাগল-দুম্বা; এসবের মধ্যে বসবাস শিয়া সম্প্রদায়ের একদল মানুষ। মানুষজন ইরানি নামে চেনে। তাদের এখন কেউ বেঁচে নেই। এই যে কোথায় কী যেন নেই, ছিল কিংবা আছে অথবা এখন নেই…তার নাম ভয়। স্বস্তি উধাও হয়ে গেছে। আমরা রাত নয় কিংবা দশের দিকে এখানে আসি। একটি রং চটা ক্যারামবোর্ড মেঝেতে সাজানো, ক্রাইস্টাইল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের উনিশটি গুটি আর স্ট্রাইকার বরিক পাউডারের মধ্যে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকে, যেন আমার দেশ আর মানুষজন অস্থির এদিক-ওদিক ভাবনা-দুর্ভাবনায় বিশুষ্ক আর কোনো স্বপ্ন দেখে যায়। প্রায়শ বিনোদনের এসবে কোনো মনোযোগ নেই আমাদের। আমরা অন্ধকার রাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভোরের প্রতীক্ষায় থাকি। ভোর মানে সকাল। একটি সকাল আমাদের বড় আকাঙ্ক্ষার। আমাদের নেতা সাতই মার্চ, রবিবার, আগুনঝরা ভাষণ দিলেন। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা-আল্লাহ্।’
আমরা কখনো সকালে এসে বসি। সারাদিন কেটে যায়। বাচ্চুর পকেটে কিংস্টোর্ক সিগারেট থাকে। কখনো স্টার…ফিল্টার উইলস্। মোরগ বা ট্যাক্সি মার্কা দেশলাই। আমি জানি রাফিদুলের কাছে পেট্রল লাইটার আছে। তেমন একটি জিনিস কেনার জন্য কয়েকদিন জেলরোড-লিলিমোড়ের দোকানে ঘুরেছি। অবশেষে সেই তিন-চার টাকা ক্রিসেন্ট বুক স্টলে মাসুদরানা সিরিজের বই কিনে শেষ। সিরিজের পাঁচ নম্বর বই। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। আমরা এখন সেই পাঞ্জা লড়ে যাওয়ার প্রস’তি নিই সকাল-দুপুর-বিকেল। একাডেমি স্কুলের মাঠে যখন আতা আর বেলগাছের পাতাগুলো ঝিরিঝির ঝরে পড়ে, পড়তে থাকে, কেউ কেউ রাইট টার্ন-কুইকমার্চ আর রাইফেল চালনা শেখে। আমার শেখা হলো না। বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ অফিস। গণেশতলা সেন্ট যোসেফস্স্কুল রাস্তার অপরদিকে গোডাউনের মতো বিশাল ঘর সকাল-বিকেল-রাত গমগম করে। আলাপ-আলোচনা অনেককিছু চলে। কোনোদিন উঁকি মেরে আলোচনা শুনি। একদিন মোতালেব ভাই বের হয়ে জিজ্ঞেস করেন,-
‘পড়াশোনা কেমন? দেশের জন্য এবার কাজ করো। আমাদের সাথে এসো। মাও সেতুং-কার্ল মার্ক্স-লেলিনের নাম জানো?’
‘শুনেছি। মাও সেতুং-এর বইগুলো যেন লাল কভার ডায়রি। বেশ সুন্দর দেখতে।’
‘পড়েছ?’
‘বুঝতে পারি না।’
‘একদিন বিকেলে আসবে, গল্প করব। আগামিকাল নেতার ভাষণ…শুনবে কেমন।’
আমার যাওয়া হয় না। সাতই মার্চের ভাষণ ওইদিন রেডিওতে প্রচার হলো না। বাবা পরদিন সকালে ফুল ভলিউমে ভাষণ শুনছেন। মারফি ডিলাক্স রেডিওর সাউন্ড গলির মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। উত্তরপার্শ্বের বাড়ি থেকে নন-বেঙ্গলি আহমেদ রফিক ছুটে এলেন। চুল-দাড়িতে মেহেদি রং।
‘ক্যায়া বাত উকিল সাব? শাদি লাগগিয়া ক্যায়া?’
বাবা কিছু বললেন না। ভলিউম কমিয়ে দিলেন। আমার শ্রুতিতে বেজে চলে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা-আল্লাহ্।’ আনন্দ-খুশির নেশায় রক্ত টগবগ করে নাচে। এই তো এক বছর আট মাস আগে মানুষ চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে। উনসত্তর সালের কুড়ি জুলাই, রবিবার Neil Armstrong চাঁদের বুকে পা রেখে ইথারে জলধগম্ভীর ঘোষণা ছড়িয়ে দিলেন `That’s one small step for man, one giant leap for mankind.’ আমার সপ্তর্ষি-সন্ধ্যাতারা-ধ্রুবতারা-লুব্ধক সন্ধানী মন নেচে নেচে রাস্তা, স্কুল এবং তারপর গোর-এ-শহিদ ময়দানের আড্ডায় ছুটে এলো। Willy Ley-র The Conquest of Space বই হাতে। মনের আকাশে ফ্লাইং সসার আর গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে এ্যলিয়েন অনুসন্ধান। মন আমার কোথায় হারিয়ে যায়! অলীক কল্পনা? (চলমান)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৭-০৬-২০২০ | ৮:৫৯ |

    'এই যে কোথায় কী যেন নেই, ছিল কিংবা আছে অথবা এখন নেই…তার নাম ভয়। স্বস্তি উধাও হয়ে গেছে।' … আপনার প্রত্যেকটি লিখা ভীষণ ডিটেইলে আসে। পর্বটি আমাকেও সেই ফেলে আসা সময়ে নিয়ে গেলো প্রিয় মাহবুব ভাই। আপনার মতো করে নিজেকে বোঝানোর মতো সুযোগ সেই সময়ে আমার না থাকলেও আপনার লিখায় সেটা খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। চলুক …

    GD Star Rating
    loading...
    • মাহবুব আলী : ০৯-০৬-২০২০ | ১৬:৫৯ |

      অনেক অনেক ধন্যবাদ মুরুব্বী ভাই।

      GD Star Rating
      loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০৭-০৬-২০২০ | ১৪:২৫ |

     সুলিখিত   ,শ্রুতিমধুর  লেখা।  । 

    GD Star Rating
    loading...